জীবনের মুখোমুখি
অর্পিতা দত্ত
এবারে পর্দার রঙ গোলাপী বদলে নীল হল এবং আমার নতুন বন্ধুটির নাম টুটু৷ এই তিন দিন হল টুটুরা এখানে এসেছে৷ওর আগে বিল্লু এবং বিল্লুর আগে আমার বন্ধু ছিল তুন৷ কি অদ্ভুত সব নাম তাই না? অবশ্য এসব ওদের ডাক নাম, এছাড়া একটা করে ভালো নামও আছে৷ এখনকার দিনের নাকি এটাই চল৷ আমাদের সময়তো একটা নাম দিয়ে ঘরে ও বাইরে চলে যেত৷ আর নামগুলো হতো যুক্তাক্ষর সহ চার-পাঁচ অক্ষর-ওলা, যেমন- সমরেন্দ্রনাথ, লক্ষীকান্ত, ধরনীকান্ত, সজনীকান্ত ইত্যাদি ইত্যাদি৷ যেমন আমার নামটাই ধরুন না কেন অবনী শংকর ব্যানার্জী; অবশ্য এখন সবাই অবনীবাবু /ব্যানার্জীবাবু বলেই ডাকে৷
তিন বছর থেকে ছোট্টো তুনকে নিয়ে রথিন আর সোমা এসেছিল এবাড়িতে৷ তারপর থেকে ও আমাদের দিদুন-দাদন বলতে পাগল৷ ওর সঙ্গে খেলা, ওকে স্কুলে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা সবই এই দাদানের দায়িত্ব৷ আমিও তখন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত, তুনকে নিয়ে আমাদেরও সময় কাটতে লাগল৷ কিন্তু সময়তো কারো জন্য থেমে থাকে না৷তুনের বাবার বদলির চাকরি, তাই ওরা সপরিবারে মালদা চলে গেল৷ যাবার সময় তুনের জলে ভরা চোখ আমার আজও মনে পড়ে৷
তুনরা চলে যাবার পর কিভাবে যে আমাদের দিন কেটেছিল সে শুধুমাত্র আমি ও আমার গিন্নি ছাড়া আর কেউ জানেনা৷তারপরই ঠিক করে ফেললাম যদি বাড়ি ভাড়া দিতে হয় তবে এমন কোন পরিবারের কাছে যেখানে আমার ছোট্ট বন্ধু আছে৷
এরপর এল বিল্লু ৷ প্রায় সাঢ়ে তিন বছ বিল্লুরা আমাদের বাড়িতে ছিল৷ ওর বাবার বদলি হয়ে যাওয়ার জন্য ওদের শিলিগুড়ি চলে যেতে হয়েছে৷ যখন বিল্লু আমাদের বাড়িতে এসেছিলো তখন ও ক্লাস ওয়ানে পড়ে৷ দেখতে দেখতে তিন বছর কেটে গেল৷
গল্প প্রসঙ্গে আমাকে নিঃসন্তান মনে হলেও বাস্তবে আমার এক পুত্র, পুত্রবধু, নাতী ও নাতনী বর্তমান৷সায়ন যেবার মেডিকেলে চান্স পেল তখন বাড়িসুদ্ধ লোকের কি আনন্দ৷ ভেবেছিলাম ও ডাক্তার হয়ে ফিরে এলে একটি দাতব্য চিকিত্সালয় খুলে দেব৷ যেখানে বিনা খরচায় গ্রামের রোগীদের চিকিত্সা হবে৷ কিন্তু তা আর হলো কোথায়৷ স্বপ্নের জগv আর বাস্তব জগv-এর বিশাল ব্যবধান তা ছেলে বুঝিয়ে দিল৷ সায়ন পাশ করে ওখানকারই এক সরকারী হাসপাতালে চাকুরী ও প্রাকটিস শুরু করে দিল এবং ওখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নিল৷ প্রথম প্রথম ছুটি-ছাটায় বাড়ি আসলেও পরে তা কমে গেল৷ ওর মার কথামত দেখে শুনে এখানকারই মেয়ে কনিকার সাথে ওর বিয়ে দিলাম৷ ভেবেছিলাম ছেলে আমার বাপের বাড়ির টানে যদি আসে! কিন্তু এই চেষ্টাও বিফল৷ সুতরাং আমরা এখআনে দুই বুড়ো-বুড়ি থেকে গেলাম৷
আমার ধারনা ছিল যাদের ঘরে শুধুমাত্র কন্যা-সন্তান থাকে তারাই কেবল শেষ বয়সে মেয়ে বিয়ে দিয়ে বুড়ো-বুড়ি একে অপরের সঙ্গী হয়৷ কিন্তু এখন সেই ধারণা পুরোপুরি ভুল৷ সকলে বলে থাকে আজকের দিনে ছেলে-মেয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, সবাই সমান৷ এই সত্যের যথাযথ প্রমান পেয়েছি আমি ও আমার গিন্নি৷ আমার যদি এখন ছেলে না থেকে একটা মেয়ে থাকত, সেওতো আমাদের ছেড়ে তার নিজের ঘরকন্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতো!----- তাই বলে মনে করবেন না সায়নের প্রতি আমার কোন অভিমান আছে৷ ওতো ওর নিজের কর্তব্য পালন করছে৷
প্রত্যেক মানুষের মতো আমারও স্বপ্ন ছিল শেষ বয়সে স্ত্রী, ছেলে, ছেলেবউ, নাতী-নাতনী নিয়ে ভরা সুখী জীবন৷কিন্তু ওই বললাম স্বপ্নের জগv আর বাস্তব জগv-এর ব্যবধান৷ ইচ্ছে থাকলে ও উপায় নেই৷ যারা এখন মধ্য গগনে তারা এখন ভাবতে পারেন বুড়োটা একা থেকে থেকে হতাশায় ভুগছে৷ কিন্তু তা নয়, আমিতো আমার ছোট্টো বন্ধুদের নিয়ে ভালোই আছি৷শুধু মাঝে মাঝে বুবাই আর তিতলির জন্য বড় খারাপ লাগে; তাছাড়া ছোটো থেকে ঠাম্মি-দাদুর আদর কতটুকুই-বা পেয়েছে ওরা৷
##################